আইজ্যাক নিউটন: একটি পর্যালোচনা
অতি সম্প্রতি প্রফেসর ড. বিধান চন্দ্র দাস নিউটনের জীবনী নিয়ে একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম দিয়েছেন, 'আইজ্যাক নিউটন'। আমরা গণিত এবং পদার্থের বিজ্ঞানের যে নিউটনকে চিনি লেখক এর পাশাপাশি অন্য জগতের নিউটনকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন।
গণিতের ছাত্র বা শিক্ষক বলে আলতোভাবে নিউটন সর্ম্পকে অনেক কথা জানতাম বলে মনে করতাম। কিন্তু ড. বিধান চন্দ্র দাসের 'আইজ্যাক নিউটন' পড়ার পর বুঝতে পারলাম কত কথায় অজানা ছিল আমার। বইটি পড়তে গিয়ে কখনও মনে হয়নি বিজ্ঞানী নিউটন পড়ছি। সব সময় মনে হচ্ছিল আমি নিউটনের সুখ-দুঃখে ভরা একটি পারিবারিক কাহিনী পড়ছি।
বইটি লিখতে গিয়ে লেখক অনেক তথ্য-উপাত্ত ঘেটে পাঠকদের সামনে এক নতুন নিউটন তুলে ধরেছেন। ছোট বেলা থেকেই নিউটনকে নানা প্রতিকুলাতার মধ্য দিয়ে বড় হতে হয়েছে।
জন্মের পূর্বেই পিতার মৃত্যু এবং তিন বছর বয়সে মায়ের অন্যত্র বিয়ে এগুলো সবই ছিল নিউটনের মনোজগতের উপর প্রচন্ড আঘাত। তাই, বিশ বছর বয়সে নিউটনের করা পাপের একটি তালিকা থেকে জানা যায়, তিনি সৎ পিতা ও মাতাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার কথা
ভাবতেন।
এ জন্য তাঁর অনেক জীবনীকার নিউটনের মাকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। বিষয়টি নিয়ে প্রফেসর ড. বিধান চন্দ্র দাস অনেক তথ্য-উপাত্ত ঘেটে দেখিয়েছেন যে, এর জন্য ছিল সেই সময়ের সাবির্ক পরিস্থিতি এবং এ জন্য তাঁর মাকে দায়ী করলে তাঁর মায়ের প্রতি অবিচার করা হবে। অন্য পাঠকদের কী মনে হবে জানি না, আমার ক্ষেত্রে মনে হয়েছে প্রতি পৃষ্ঠায় নতুন কিছু জানলাম।
শিশু নিউটনের জীবন ছিল একাকিত্বে ভরা। তাই চারপাশের ভৌত পরিবেশই হয়ে উঠেছিল তাঁর নিঃসঙ্গ বন্ধু। নিউটন ছোটবেলা থেকেই তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন বিভিন্ন কাজে।মাটিতে কাটি পুঁতে সময় মাপা, ঝাপ দিয়ে ঝড়োবাতের গতিসহ নানা কাজ তাকে আনন্দ দিত। লেখক বইটিতে নিউটনের ছোট বেলার অনেক আবিস্কার ও কাজের বর্ণনা দিয়েছেন যা স্কুলগামী ছাত্রদের অনেক আনন্দ দিবে এবং তাঁকে জানার সুযোগ হবে।
তাঁর নানান আবিস্কারের মধ্যে গতির সূত্র, মহাকর্ষ বলের সুত্র এবং ক্যালকুলাস আবিস্কারের মাধ্যমে তিনি বিশ্ব দরবারে বেশী পরিচিতি পান এবং এখনও পর্যন্ত তাঁকে সর্বকালের প্রভাবশালী বিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তবে তাঁর গবেষণা কাজে স্বীকৃতি পেতে অনেক প্রতিকুলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। বিশেষ করে রয়েল সোসাইটির কিউরেটর রবার্ট হুক নিউটনের নানা কাজে বিরোধিতা এবং প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে কিভাবে বিবাদ তৈরী করতেন তা ড.বিধান চন্দ্র দাস বিভিন্ন তথ্য ও রেফারেন্স দিয়ে পাঠকের সামনে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন।
বিশেষ করে ক্যালকুলাসের আবিস্কারের অগ্রাধিকার প্রশ্নেও নিউটন ও লাইবনিজকে ঘিরে বিতর্ক হয় এবং তা ১৭১৬ সালে লাইবনিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলতে থাকে। চন্দ্র পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করেও নিউটন-ফ্লামস্টিডের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। আসলে আমরা নিউটনের আবিস্কারগুলো যত সহজে দেখতে পাই কিন্তু এর প্রতিষ্ঠার পেছনের কাহিনীগুলো মোটেও সুখকর ছিল না তা লেখক বইটিতে উপাস্থাপন করেছেন।
গবেষণার পাশাপাশি নিউটন কিভাবে অন্যায়ের-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন এবং এ কাজ করতে গিয়ে তাঁর রাজনীতিবিদ হওয়ার গল্পও লেখক বিস্তারিত তুলে ধরেছেন বইটিতে।
রাজা দ্বিতীয় জেমস ছিলেন একজন গোঁড়া ক্যাথলিক। তিনি প্রায় সব জায়গায় অন্য ধর্মালম্বীদের সরিয়ে দিয়ে সিনিয়র পদে ক্যাথলিকদের বসাতে শুরু করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ে তা অব্যাহত রাখেন। এই হস্তক্ষেপ নিউটনকে বিক্ষুব্দ করে তোলে এবং এর প্রতিরোধে নিউটনকে রাজনীতির মাঠে আসতে অনেকটা বাধ্য করে।
জেমসের পতন ঘটিয়ে নতুন রাজা উইলিয়াম ক্ষমতাসীন হন এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি তৈরির কথা ভাবেন। এতে নিউটন পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি পার্লামেন্টে আইন তৈরি এবং অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও সুযোগ-সুবিধা বিল করতে নানাভাবে সহযোগিতা করেন।
নিউটনের মানবিকতা বিষয়ে অপেক্ষাকৃত কম লেখা হয়েছে বলে মনে করেন লেখক। যতটুকু লেখা হয়েছে সেখানে কেউ কেউ তাঁর ক্রোধ, প্রতিহিংসা, বদমেজাজ, লোভ ইত্যাদি সর্ম্পকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তাঁকে অমানবিক করে তোলা হয়েছে বলে মনে করেন লেখক ড. বিধান চন্দ্র দাস। নিউটন ছিলেন অবিবাহিত। তাই তাঁর অর্থ-বিত্ত তিনি অসহায়, আত্বীয় স্বজন এবং জনকল্যানমূলক কাজে অকাতরে বিলিয়েছেন।
তাঁর কাছে কেউ হাত পাতলে কাউকে খালি হাতে ফেরাতেন না। তাঁর মায়ের মৃত্যুর শেষ দিনগুলোতে নিউটন পাশে থেকে মায়ের সেবা-যত্ন করেছেন। নিউটনের মানবিকতার নানান উদাহরণ লেখক বইটিতে তুলে ধরেছেন এবং ধর্ম নিয়েও তাঁর একটা নিজস্ব মতবাদ ছিল তাও এসেছে বইটিতে। নিউটনের বাহ্যিক আচরণ দেখলে মনে হতো, তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ খ্রিস্টান।
তিনি ত্রিত্ব মতবাদ (পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্ম) সঠিক নয় বলে মনে করতেন। তাঁর মতে যিশুখ্রিস্ট ঈশ্বরের সমতুল্য কেউ নন, তবে অবশ্যই স্বর্গীয় ঐশ্বরিক সত্তা। নিউটন ধর্ম পালন করতেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস দিয়ে তিনি কাউকে প্রভাবিত করতেন না। অবশ্যই নিউটন সাধারণ কোনো মানুষ ছিলেন না। তাঁর কর্ম ও আদর্শের মাধ্যমে মানবজাতির অন্যতম শ্রেষ্ট সন্তান হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছিলেন।
বইটি পড়ার পর আমার মনে হয়েছে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর এটা অবশ্যই পড়া দরকার। ড. বিধান চন্দ্র দাসকে ধন্যবাদ এ বই লেখার জন্য এবং আমার মতো অনেককে নিউটন সর্ম্পকে নতুন ধারণা দেয়ার জন্য। এটি লেখকের প্রথম বই। আশা করি পাঠক দরবারে এটি সমাদৃত হবে এবং আরও বই লেখার উৎসাহ যুগাবে।